শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩২ পূর্বাহ্ন

কেউ কি দেখেছেন এই রেখাকে?

ভানুরেখা গণেশন ওরফে রেখা। কেউ কি কখনো দেখেছেন এই রেখাকে? তিনি আছেন সবার মাঝে। কাজ করছেন, কথা বলছেন, আড্ডা দিচ্ছেন, খাবার খাচ্ছেন, নিজের মতো করে সময় কাটাচ্ছেন। এর মাঝেই যাঁরা তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁকে অনুভব করেছেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন এই ‘অন্য রেখা’কে নিজের মতো আবিষ্কার করেছেন। আজ রেখার জন্মদিন। আজকের দিনে তাঁদের দেখা অন্য রেখাকে তুলে ধরা হলো এই প্রতিবেদনে।

রেখা কার সঙ্গে কথা বলছেন?
রেখার নাকি তাঁর মেকআপ কিটের সঙ্গে কথা বলার অভ্যাস। আলোকচিত্রী জয়েশ শেঠ বললেন, ‘প্রথম যখন দেখি রেখা লিপস্টিকের সঙ্গে কথা বলছেন, আমি সত্যিই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম নিজের লিপস্টিক, ব্লাশঅন, চুল, এমনকি কস্টিউমের সঙ্গেও কথা বলতে শুরু করলেন। একদম বাচ্চাদের মতো করে ওগুলো হাতে নিয়ে বোঝাচ্ছেন। ধরুন, একটা লেস জামার ওপরে ঠিকভাবে বসছে না। রেখা বললেন, “কাম অন বেবি…”। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কার সঙ্গে কথা বলছেন? রেখা বললেন, “জয়েশ, দে আর মাই বেবিজ। ডু ইউ ওয়ান্ট টু সি দেম লিসেন টু মি?” এরপর নিজের দোপাট্টাটা অ্যাডজাস্ট করতে করতে ফোল্ডটাকে বোঝালেন, ঠিক যেমনটি চাইছেন, সেভাবেই যেন “সে” বসে থাকে! তখন ছবি তুলব কী, এসব দেখে আমার তো পুরো আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা!’

সুচিত্রা সেনের সঙ্গে অনেক মিল
রেখার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা তিনি বললেন এভাবে, ‘সেটে দেখলাম, রেখা সব সময় ইনকন্ট্রোল। কী মেকআপ হবে, কোন কস্টিউম পরবেন, সব নিজে ঠিক করেন।’ শুটিং সেটে রেখার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন শেখর সুমন। রেখা জিজ্ঞেস করলেন, ‘অমন করে তাকিয়ে আছো কেন?’ শেখর তাঁকে বললেন, সাত বছর আগে মুম্বাই এসে ‘পরমাত্মা’ ছবির শুটিং দেখতে গিয়েছিলেন। সেখানে ঠেলাঠেলি আর ধাক্কাধাক্কির মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। আর সেই শেখর সুমন এখন রেখার সঙ্গে অভিনয় করছেন! শুনে রেখা হাসলেন। শেখর সুমনের মতে, ‘রেখার সেই হাসির ভাষা বোঝে কার সাধ্য? রেখা চিরকালই প্রহেলিকা। অনেকটা যেন সুচিত্রা সেন। যত কম প্রকাশ পাবে, তাঁর প্রতি লোকের কৌতূহল ততই বাড়বে। কখন কতটা বলতে হবে, কতটা নৈশব্দ্যের প্রয়োজন হবে, সব তিনি জানেন।’

বন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ
অভিনেতা রাকেশ রোশন আর রেখা একসঙ্গে অভিনয় করেছেন ‘খুবসুরত’, ‘বহুরানি’, ‘খুন ভরি মাঙ্গ’ আর ‘আক্রমণ’ ছবিতে। আবার রাকেশ রোশন পরিচালিত ছবিতে অভিনয় করেছন রেখা—‘কোয়ি মিল গ্যায়া’, ‘কৃষ’ আর ‘কৃষ থ্রি’। এই তিনটি ছবিতেই অভিনয় করেছেন হৃতিক রোশন। রেখার সঙ্গে রোশনদের এখন পারিবারিক বন্ধুত্ব। রাকেশ রোশন বললেন, ‘একসঙ্গে অভিনয় করার সময় আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছিল। পরিচালক হয়ে দেখেছি, রেখা খুব পরিশ্রমী অভিনেত্রী। স্ক্রিপ্ট দেওয়ার পর একবার আলোচনা করে নেন। তারপর নিজেই ঠিক করেন কী ধরনের কস্টিউম পরবেন। সব থেকে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো আমি যখন তাঁকে বললাম, কস্টিউমটা হয়তো দৃশ্যের জন্য একটু লাউড হয়ে যাচ্ছে, দেখি ও নিজেই তার অলটারনেটিভ সাজেশন দিচ্ছে। পরে ভেবে অন্য অপশন দিয়েছে, তা কিন্তু নয়, সঙ্গে সঙ্গেই একটা অনন্য অলটারনেটিভ রেডি।’ রেখাকে দেখে যতটা গম্ভীর মনে হবে, সেটে কিন্তু তিনি একদমই অন্য রকম। রাকেশ রোশন আরও বললেন, ‘আমরা না হয় পরিবারের মতো হয়ে গেছি। ইউনিটের অন্যদের সঙ্গে একবার আলাপ হয়ে গেলে দেখেছি, রেখা সবার সঙ্গে দারুণ মিশে যান। খাওয়া নিয়ে কোনো আলাদা ঝামেলা করেন না।’‘উমরাও জান’ ছবিতে রেখা

রেখার কিছু পছন্দ
মায়ের পুরোনো শাড়ি পরা রেখার খুব পছন্দের। কখনো আবার দুটি শাড়িকে কেটে একটা প্যাটার্ন বানিয়ে পরতে দেখা যায় তাঁকে। ফ্যাশন ম্যাগাজিনে কোথায় কী খুঁটিনাটি বেরিয়েছে, তার ‘আপডেট’ রাখেন। কিন্তু কোনো দিন এতটুকু কপি করেননি। বরং নিজেই স্টাইল-স্টেটমেন্ট তৈরি করেন। যেমন একবার শুরু করেছিলেন ডার্ক লিপস্টিক পরার চল। অবসরে জনপ্রিয় মার্কিন টক শো হোস্ট অপরাহ উইনফ্রের শো দেখেন। মেজাজ ঠিক রাখতে মেহেদি হাসান আর গুলাম আলীর গজল শোনেন। তার সঙ্গে অবশ্যই ম্যাডোনার গান।

নিজেই নির্দেশক
ভারতের অন্যতম সেরা মেকআপ আর্টিস্ট মিকি কনট্রাক্টরের সঙ্গে কাজ করেন রেখা। পরে মিকি বললেন, ‘ওই শুটে রেখা নিজেই মেকআপ করেছিলেন। মাথায় এক ঢাল চুল। একদম ঈশ্বরপ্রদত্ত। একটা পাগড়ি বানিয়ে শুট করেছিলাম। রেখাকে নিয়ে শুট করার সময় শুধু দূরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখাও একটা শিক্ষা। নিজেই নিজের শুটগুলো স্টাইল করে। এমনকি ব্যাকড্রপটা কেমন হবে, সেটাও ঠিক করে দেয়। একবার দেখি, বাসা থেকে ফেব্রিক নিয়ে এসে বলল, ওটা দিয়েই ব্যাকড্রপটা হবে। শুধু ছবি তোলা নয়, নিজে ছবি এডিট করেন। তাই আজ পর্যন্ত কোনো দিন রেখার একটা খারাপ ছবি কোনো ম্যাগাজিনে কেউ দেখেনি। যদি কোনো ফোটোগ্রাফার অবাধ্য হন, তাহলে রেখা তাঁর সঙ্গে দ্বিতীয়বার শুট করেন না।’

জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ 
শুটিংয়ের সময় নাকি জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সব কাজ রেখা নিজে করতেই পছন্দ করেন। নিজের পোশাক নিজেই ইস্তিরি করেন। কোনো হেয়ার ড্রেসার থাকে না। কোনো মেকআপ আর্টিস্টের প্রয়োজন নেই। কিন্তু একটা বিষয়ে তিনি সব সময় খুঁতখুঁতে, তা হলো ‘নাক’। আলোকচিত্রী জয়েশ শেঠকে নাকি বলতেন, ‘তোতাপাখির মতো নাক তাঁর। সেটা মাথায় রেখেই শুট করতে হবে। কোনো সাইড প্রোফাইলে ছবি তোলা যাবে না। বেশি লো অ্যাঙ্গেল হলেও চলবে না। তাতে নাক বড় দেখাতে পারে। আবার খুব টপ অ্যাঙ্গেলও পছন্দ নয়। প্রথম প্রথম তো বলতেন, “ওয়াইল্ড স্মাইল” ছবিও তোলা যাবে না। তখন একমাত্র অবসেশন হলো পাউট, ওর ঠোঁটযুগল।’ জয়েশ শেঠ আরও বললেন, ‘ঠিক করলাম, তাঁর এই ধারণাটা ভাঙতে হবে। বললাম, আমি চাই যে আপনার ফ্যানরা সত্যিকারের রেখাকে চিনুক। রেখা শুনবেন না, আমিও ছাড়ব না। শেষে ঝগড়া করতে করতে হেসে ফেললেন। বললেন, “ইশ্‌, এ রকম করে ছবি তুললে আমার দাঁতগুলো দেখা যাবে।” আমি নাছোড়। ঝগড়া করতে করতেই কয়েকটি ছবি তুলে ফেললাম। পরে ওই ছবিগুলো দেখে একটা তিনি পছন্দ করেন।’রেখা

যেখানে যেমন
শুধু পোশাক নিয়ে নিরীক্ষা কিংবা ক্যামেরার সামনে খুঁতখুঁতানি নয়; মেকআপ, অ্যাকসেসরিজ ব্যবহার নিয়েও রেখা অদ্ভুত রকমের ‘ইনোভেটিভ’। আলোকচিত্রী জয়েশ শেঠ বলেন, একবার উদয়পুরে গিয়েছিলেন একটা শুটে। ঘোড়ার সঙ্গে শুট। অদ্ভুত ব্যাপার, ঘোড়াটাও রেখার কথায় পোষ মেনে গেল। বাদামি রঙের ঘোড়া দেখে রেখা ঠিক করলেন, তাঁর ট্যান মেকআপ দরকার। পরে নিলেন গ্লেয়ারস আর ম্যাচিং লিপস্টিক। আর চুলটা বেঁধে নিলেন পনিটেল করে। আর একবার একটা গাছের গুঁড়ির ওপরে বসে শুট করতে হবে। চামড়ার করসেট পরে শুট। রেখার পরনে শুধু অন্তর্বাস।

‘শোলা শাওন’ থেকে ‘সুপার নানি’
ইন্দর কুমারের ‘সুপার নানি’ ছবিতে অভিনয় করছেন রেখা। সেই ছবির সেট থেকে তোলা ছবি দেখলে বোঝা যায়, ‘শোলা শাওন’-এর রেখা আর ‘সুপার নানি’র রেখার মধ্যে কতটা ফারাক। নিজের কাছে সেই সরল অঙ্কের হিসাবটা এত স্বচ্ছ বলেই হয়তো অনায়াসে চমকে দিতে পারছেন আজও। পাশাপাশি না-জানা, না-বলা এক রেখাকে ঢেকে রেখেছেন নিজের তৈরি এক আস্তরণের আড়ালে। যার পেছনে ঘাই মারছে বহু না-বলা কথা। আর তাঁর বাস্তব জীবনের সিলসিলাকে নিয়ে না-উত্তর দেওয়া প্রশ্নের বিহ্বলতা ও তার উষ্ণতা। সেখানেই কি রেখা-রহস্যের আশ্চর্য প্রাণভোমরা শুয়ে আছে?

জীবনযুদ্ধের সফল যোদ্ধা
১৯৫৪ সালের ১০ অক্টোবর তামিল অভিনেতা জেমিনি গণেশন আর তেলেগু অভিনেত্রী পুষ্পাভাল্লির ঘরে জন্ম রেখার। বড় হয়ে রেখা তাঁর বাবার পদচিহ্ন অনুসরণ করেন। যদিও তিনি অর্ধেক তামিল এবং অর্ধেক তেলেগু, কিন্তু বাসায় তেলেগু ভাষায় কথা বলেন। এ ছাড়া ইংরেজি, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় রয়েছে রেখার দক্ষতা। রেখার বাবা-মা বিবাহিত ছিলেন না। ছোটবেলা রেখাকে স্বীকার করেননি বাবা। শৈশবেই রেখা স্কুল ত্যাগ করেন। জীবনধারণের তাগিদে অল্প বয়সেই সিনেমায় নামতে বাধ্য হন। ১৯৬৬ সালে ‘রাঙ্গোলা রত্নম’ নামে একটি তেলেগু ছবির মাধ্যমে শিশুশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রজীবন শুরু করেন রেখা। নায়িকা হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন ১৯৭০ সালে, ‘শাওন ভাড়ো’ ছবিতে। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি আর্ট ফিল্মেও অভিনয় করেছেন। দীর্ঘ ৪১ বছরের চলচ্চিত্রজীবনে তিনি প্রায় ২০০টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তিনবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতেন, দুবার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে ও একবার শ্রেষ্ঠ সহ-অভিনেত্রী হিসেবে। ১৯৮১ সালে ‘উমরাও জান’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ২০১০ সালে তিনি পেয়েছেন ‘পদ্মশ্রী’ সম্মাননা। সূত্র: ইন্টারনেট।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন

ওয়েবসাইটের কোন কনটেন্ট অনুমতি ব্যতিত কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Design & Developed BY ThemesBazar.Com